ভূমিকা
“একটা প্রকল্প ১০ বছর ধরে আট'কে থাকার মানে কী? ঢাকার মানুষ কি আরও ১০ বছর ভূগ'র্ভস্থ পানি খেয়ে পরিবেশ ধ্বং'সের দায় নেবে?” — প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহা'ম্ম'দ ইউনূসের এই উষ্মা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের দুটি গু'রুত্বপূর্ণ পানি শোধনাগার প্রকল্পের নির্মাণ স্থবিরতার গভীর সংকট। ‘সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-৩’ ও ‘মেঘনা নদী রক্ষার মহাপরিকল্পনা’ নামে এই প্রকল্প দুটি কেন এক দশকেও আলোর মুখ দেখছে না? কী প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে? আসুন, গল্পের ছলে জেনে নেওয়া যাক।
প্রকল্প দুটির প্রাথমিক পরিচয়
সায়েদাবাদ ফেজ-৩: ঢাকার তৃষ্ণা মেটানোর স্বপ্ন
ঢাকার ২ কোটিরও বেশি মানুষের নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে চালু হওয়ার কথা ছিল সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের তৃতীয় পর্যায়। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি শোধন করে সরবরাহ করা সম্ভব 'হতো, যা ভূগ'র্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতো ৩০% পর্যন্ত (সূত্র: ঢাকা ওয়াসা, ২০২২)।
মেঘনা নদী রক্ষার মহাপরিকল্পনা: নদীর প্রাণ ফেরানোই লক্ষ্য
মেঘনা নদী দূষণ রোধ ও এর প্রবাহ পুনরুজ্জীবিত করতে ২০১৪ সালে হাতে নেওয়া হয় এই প্রকল্প। নদীর তীরে শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিক দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত মাটি কা'টা বন্ধ করে নদীটিকে জীবন্ত রাখাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু এক দশক পরও প্রকল্পটি কাগজেই সীমাব'দ্ধ!
১০ বছরেও অগ্রগতি না হওয়ার পেছনের কারণ
১. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: ফাইলের গল্প
স্থানীয় সরকার বিভাগ, ওয়াসা, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)—একাধিক সংস্থার সমন্বয়হীনতাই মূল বাধা। ২০২১ সালের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়, প্রকল্প অনুমোদনে ১৭টি কমিটির অনুমোদন লাগে, যার প্রতিটিতে সময় লাগে গড়ে ৬ মাস (সূত্র: ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি)।
২. অর্থায়নের অনিশ্চয়তা
মেঘনা প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ ছিল ১,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও জাইকার মতো দাতা সংস্থাগু'লো আগ্রহ হারায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে। ২০২০ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রকল্পের ডিজাইন পরিবর্তন হয়েছে ৪ বার, প্রতি বারেই বাড়ছে ব্যয়।”
৩. রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের অভাব
নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. আদনান মোর্শেদের মতে, “পানি প্রকল্পের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগু'লো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় তালিকাভুক্ত হয় না। দৃশ্যমান অবকাঠামো (যেমন: সেতু, ফ্লাইওভার) বেশি ভোট আকর্ষণ করে।”
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে প্রভাব: সংখ্যায় যা বলছে
ভূগ'র্ভস্থ পানির স্তর বিপদসীমায়
বাংলাদেশ জল উন্নয়ন বোর্ডের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ভূগ'র্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ২.৫ মিটার নিচে নামছে। এর প্রধান কারণ সায়েদাবাদ ফেজ-৩ বাস্তবায়ন না হওয়া। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন সতর্ক করেছে: ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার ৪০% এলাকায় ভূগ'র্ভস্থ পানি সম্পদ শেষ হয়ে যাব'ে।
মেঘনা নদীর করুণ দশা
পরিবেশ অধিদ'প্তরের ২০২২ সালের সমীক্ষা বলছে, মেঘনায় দূষণের মাত্রা মানব ব্যবহারের অযোগ্য স্তরে পৌঁছেছে। নদীর পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ প্রতি লিটারে ০.১ মিলিগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমা'র চেয়ে ১০ গু'ণ বেশি! নদী তীরবর্তী এলাকায় ক্যান্সার ও কিডনি রোগের হার জাতীয় গড়ের দ্বিগু'ণ (সূত্র: আইসিডিডিআর,বি)।
প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক: কী আলোচনা হলো?
ইউনূসের তিনটি কঠিন প্রশ্ন
৯ মা'র্চ যমুনা রিসোর্টে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ড. ইউনূস সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে তিনটি প্রশ্ন রাখেন:
১. “১০ বছরেও একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার দায় কার?”
২. “আমর'া কি ভবি'ষ্যৎ প্রজন্মকে বি'ষাক্ত পানি খাওয়ার অধিকার দিচ্ছি?”
৩. “এত সংস্থার সমন্বয় না হলে কি প্রকল্প সম্ভব?”
স্টেকহোল্ডারদের প্রতিক্রিয়া
- ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান: “জমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদারি জটিলতা প্রধান সমস্যা।”
- পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধি: “২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্প দুটিকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে।”
- পরিবেশ মন্ত্রণালয়: “মেঘনা প্রকল্পের জন্য নতুন করে ডেল্টা প্ল্যান প্রস্তাব করা হয়েছে।”
বিশ্বজুড়ে সফল উদাহরণ: বাংলাদেশ কী শিখতে পারে?
সি''ঙ্গাপুরের NEWater মডেল
সি''ঙ্গাপুর তাদের NEWater প্রকল্পে বৃষ্টির পানি ও বর্জ্য পানি রিসাইকেল করে ৪০% চাহিদা মেটায়। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আদর্শ মডেল 'হতে পারে, বিশেষ করে ঢাকার মতো নগরীতে।
ভারতের যমুনা একশন প্ল্যান
দিল্লিতে যমুনা নদী পুনরুজ্জীবনে ২০২৬ সালের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় কমিউনিটি, শিল্প ও সরকারের যৌ'থ অংশগ্রহণ জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
সমাধানের রোডম্যাপ: আগামী ৫ বছর কী করা যেতে পারে?
১. প্রকল্প তদারকিতে টাস্কফোর্স গঠন
সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞ ও তরুণ প্রকৌশলীদের নিয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন, যারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়কে রিপোর্ট করবে।
২. প্রযুক্তির ব্যবহার
- ড্রোন সার্ভে: মেঘনা নদীর দূষণ সনাক্তকরণে।
- ব্লকচেইন: ঠিকাদারি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে।
৩. জনসচেতনতা বাড়ানো
স্কুল-কলেজে “নদী বাঁচাও” ক্যাম্পেইন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইনফোগ্রাফিক্স শেয়ার করা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: আশা ও সতর্কতা
ড. আইনুন নিশাত, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ
“প্রকল্প দুটির বাস্তবায়ন জলবায়ু অ'ভিযোজনের অংশ। দ্রুত কাজ শুরু না করলে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।”
আরিফিন খান, নগর পরিকল্পনাবিদ
“এখানে শুধু পানি প্রকল্প নয়, একটি সুপরিকল্পিত মেগাসিটির রূপরেখা দরকার। সায়েদাবাদ ও মেঘনা প্রকল্প সেই পরিকল্পনার প্রথম ধাপ।”
নাগরিকদের ভূমিকা: আমর'া কী করতে পারি?
- প্লাস্টিক বর্জ্য কমানো, নদীতে ময়লা না ফেলা।
- স্থানীয় সরকারকে প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে RTI (তথ্য অধিকার) আবেদন করা।
- সচেতনতা তৈরি করতে আর্ট-ক্যাম্পেইনের অংশ হওয়া।
উপসংহার: সময় এখনই
প্রধান উপদেষ্টার বিস্ময় শুধু একটি প্রশ্নেরই ই''ঙ্গিত দেয়: আমর'া কি আমা'দের ভবি'ষ্যৎকে বি'ষাক্ত পানি ও মর'ুভূমির দিকে ঠেলে দিতে চাই? সায়েদাবাদ ও মেঘনা প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন শুধু পানি সরবরাহই নয়, একটি টেকসই বাংলাদেশের ভিত্তি তৈরি করবে। ড. ইউনূসের কথায় শেষ করি: “১০ বছর হারানোর পরও, আজ থেকেই শুরু হোক নতুন যাত্রা।”
প্রায়শ জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
প্র: প্রকল্প দুটি কবে শেষ হবে?
উ: সরকার ২০২৮ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তবে বাস্তবায়ন গতির ওপর নির্ভর করছে।
প্র: সাধারণ মানুষ কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
উ: পানি অ’প'চয় রোধ, দূষণ রিপোর্টিং ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমে যোগ দেওয়া।
প্র: প্রকল্প বিলম্বের দায় কার?
উ: সমন্বয়হীনতা, অর্থায়ন ও নীতিগত দুর্বলতার জন্য একাধিক সংস্থা দায়ী।